নাকের পলিপাস একটি মারাত্মক সমস্যা। এটা দূর করার উপায় জানতে চাই আমরা। আমাদের দেশে প্রায় মানুষেরই হয়ে থাকে সঠিক সময় সঠিক চিকিৎসা না করায় এটা মারাত্মক আকার ধারণ করে।তাই আজকে আমরা আলোচনা করবো কিভাবে বুঝবো নাকের পলিপাস হয়েছে কিনা এর কারন কি? এবং নাকের পলিপাস দূর করার সঠিক চিকিৎসা।
নাকের পলিপাস হওয়ার কারণ ও আধুনিক চিকিৎসা।
আসলে নাকে পলিপাস হওয়ার কথা আমরা প্রায় সবাই কম-বেশি শুনেছি বা জানি । আর রোগীরা পলিপাস বলতে সাধারনত যা বুঝে থাকে যা মেডিকেলের ভাষায় আমরা সেটিকে পলিপাস বলে থাকি না। আমাদের নাকের আশপাশে কিছু প্রকোষ্ঠ বা (সাইনাস) আছে। যা আমাদের চোখের ঠিক নিচেই যে উঁচু হাড়টি আছে তার ভেতরে এটি থাকে।
ম্যাক্সিলারি সাইনাস, যা নাক আর চোখের মাঝখানে যেই ক্ষুদ্র স্থান আছে সেখানে থাকে এবং বেশ কয়েকটি ইথময়েড সাইনাস ও থাকে । আর কপালের সম্মুখভাগে থাকে ফ্রন্টাল সাইনাস। আর চোখের পিছন দিকে থাকে স্ফেনয়েড সাইনাস। আর এই সাইনাসগুলোর আবরণী গুলো অনেক সময় অনেক বেশি ফুলতে ফুলতে আঙ্গুরের থোকার মতো আকার ধারণ করে। তাই একেই আমরা ডাক্তারি ভাষায় নাকের পলিপাস বলে থাকি।
আরো পড়ুনঃ
সাধারনত ইথময়েড সাইনাস থেকে পলিপাস তৈরি হয়ে থাকে । আবার কখনও কখনও ম্যাক্সিলারি সাইনাস থেকেও এই পলিপাস তৈরি হতে পারে। আবার আমাদের নাকের মধ্যে ফাংগাস ইনফেকশনব হয় যা আমরা অনেক সময় দেখে থাকি। তাই নাকের ফাংগাল (ছত্রাক) ইনফেকশন থেকে নাকের উভয় দিকে এবং সেক্ষেত্রে একাধিক সাইনাস পলিলাস দ্বারা আক্রান্ত হতে পারে। তাই এই পলিপাস গুলো প্রাথমিক পর্যায়ে সাইনাসের ভেতর থাকে।
অনেক সময় এটা বাড়তে বাড়তে সাইনাস থেকে তা নাকের ভেতরে চলে আসে এবং তখন আমরা খালি চোখে তা আমরা নাকের ভেতরে পলিপাস দেখতে পাই। আবার এগুলো দেখতে অনেক সময় সাদা আঙ্গুরের থোকার মতো হয়ে থাকে। অনেক সময় পলিপাসের ইনফেকশন হলে অথবা আঘাতজনিত কারণে এর ত্বকের স্তর মিউকোসা ক্ষতিগ্রস্ত হলে, তা অনেক সময় এটা লালচে রং ধারন করতে পারে।
আর তাই রোগীরা সাধারনত যাকে পলিপাস বলে থাকে সেটা আসলে হলো নাকের মধ্যে মাংস ফুলে যাওয়াকে তা বুঝে থাকে।কিন্তু মেডিকেলের ভাষায় একে বলে থাকে হাইপারট্রপিড ইনফেরিয়র টারবিনেট । এটি নাকের ভেতরে, পার্শ্ব এবং দেয়ালের দুই দিকে দুইটি তাকের মতো মাংসপিণ্ড থাকে।
তাই একে আমরা ইনফেরিয়র টারবিনেট বলে থাকি । এই ইনফেরিয়র টারবিনেটের প্রদাহ হলে তার আকৃতি বড় হয়ে যায়।আর যাকে হাইপারট্রপিড ইনফেরিয়র টারবিনেট বলা হয়। আর তাই এটি সাইনাস থেকে আসে না। আসলে নাকের ভেতর থেকে এর উৎপত্তি হয় । মেডিকেলের ভাষায় এটা পলিপাস নয়। তাই অনেক ক্ষেত্রেই পলিপাস এবং হাইপারট্রপিড ইনফেরিয়র টারবিনেটের কারণ একই হয় এবং এ দুটো একসঙ্গে বিদ্যমান থাকে।
যেভাবে বুঝবেন পলিপাস হয়েছে কিনা বা পলিপাসের উপসর্গঃ
১/ এটি প্রাথমিক পর্যায়ে সাধারনত রোগিদের নাক দিয়ে সর্দি ঝরা, নাক বন্ধ হওয়ার ভাব এধরনের সমস্যায় ভোগে থাকে। তাই এই সর্দি নাকের সামনের দিকে আসতে পারে। আবার অনেক সময় এটি সামনের দিকে না এসে পিছনের দিকে চলে যায়।অনেক সময় ঢোক গিলা বা গলা পরিষ্কার করার মতো প্রবণতা দেখা যায়।
আবার নাক বন্ধ অনেক সময় থাকাটা প্রাথমিক পর্যায়ে থাকে। একদিকে থাকে এবং কিছুক্ষণ পরপর এটা দিক পরিবর্তন করে তা নাকের দুই দিকে হয়ে যায় । আবার অনেক সময় এক নাক বন্ধ থাকে আবার অনেক সময় আরেক নাক ও বন্ধ থাকে। তাই অসুখ যত বাড়তে থাকে ততই দেখা যায় ধীরে ধীরে দুটো নাকই বন্ধ হয়ে যায় এবং প্রথমে আংশিকভাবে এবং তা পরে সম্পূর্ণভাবে।
২/ এর পর হাঁচি থাকতে পারে এবং অল্প ধুলাবালিতে বা ধোঁয়াতে গেলেই প্রচণ্ড হাঁচি হতে থাকে। অনেক সময় সিগারেটের বা রান্নার ধোঁয়া সহ্য করতে পারে না এবং দম বন্ধ হয়ে আসে।
৩/ অনেক সময় নাকের ঘ্রাণশক্তি কমে যায় এবং নাকে দুর্গন্ধ ও পাওয়া যায়।
৪/ কখনো কখনো মাথাব্যথা এটি প্রাথমিক পর্যায়ে থাকে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়,যে নাকের পলিপাস যখন অনেক বড় আকার ধারণ করে ঠিক তখনি মাথাব্যথা করে । এর কারণ হলো যে অবস্থাতে আমরা পলিপাস দেখতে পাই সেই অবস্থাতে মাথাব্যথার সমস্যা থাকে না।
আর তাই মাথা এবং কপালের সম্মুখিন বা নাকের এর আশপাশে একটা বন্ধ ভাব থাকে। এই সময় রোগীর ইতিহাস নিলেই অবশ্যই দেখা যাবে,যে কয়েক মাস অথবা কয়েক বছর আগে যখন এই রোগ শুরু হয়েছিলো ঠিক তখনই তাদের মাথাব্যথার সমস্যা ছিল। তাই পলিপাস যখন বেশি বড় হয়ে যায় তখন মাথাব্যথার সমস্যাটা এতটা বেশি থাকে না।
৫/ অনেক সময় দেখা যায় কিছু কিছু রোগীর গলায় খুসখুস ভাব হয়ে থাকে। অনেকেরি আবার কাশিও হয়ে থাকে । তাই গলায় নিয়মিত প্রদাহ বা মুখ দিয়ে নিয়মিত শ্বাস নেয়ার ফলে অনেক সময় গলার স্বর বসে যায় এবং গলা বসা বা স্বরভঙ্গ থাকে।
৬/ নাকের পিছনে ইউস্টেশিয়ান টিউব আক্রান্ত হওয়ার কারণেই অনেক সময় মধ্য কর্ণের সমস্যা হয়ে থাকে।আবার কান বন্ধ বন্ধ ভাব এবং কানের ভেতরে পানি যাওয়ার কারণে ও কান বন্ধ হতে পারে । আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে ও মাথা ঘুরানোর সমস্যাও থাকতে পারে। মধ্যকর্ণের এই সমস্যা থেকে অল্প-স্বল্প মাথা ঘুরানো ভাব থেকে শুরু করে মারাত্মক রকমের এই মাথা ঘুরানোর সমস্যা থাকতে পারে।
তাছাড়াও কানের ভেতরে শোঁ শোঁ আওয়াজের সমস্যাও হতে পারে। আবার কানের ভেতরে অনেক দিন পানি জমে থাকলে তখন কানের পর্দা নষ্ট হয়ে যায়। আবার অনেক সময় তা ক্রনিক বা দীর্ঘমেয়াদের কান পাকা রোগের সৃষ্টি করতে পারে।
আরো পড়ুনঃ পাইলস বা অর্শ রোগ কি? পাইলস এর লক্ষণ ও ঘরোয়া চিকিৎসা
পলিপাস হওয়ার কারণঃ
নাকের এই পলিপাসের কারণ নিয়ে এখনও অনেক গবেষনা হচ্ছে। আর এর প্রধান কারন হলো নাকের এলার্জি অন্যতম । এই এলার্জি নাকের ভেতরে ধুলাবালি অথবা ধোঁয়া থেকে হতে পারে। আর তাই অনেকেই মনে করে থাকে নাকের ভেতরে ক্রনিক ইনফেকশনও এই এলার্জির কারন হতে পারে ।
নাকের ভেতরে ফাংগাল ইনফেকশনের এলার্জি থেকে কিছু কিছু রোগীর উভয় নাকের এবং অনেক সাইনাসজুড়ে পলিপাস তৈরি হয়। তাই নাকের ভেতরে রক্তনালির অসাঞ্জস্যতা বা অস্থিরতা থেকে অনেক সময় পলিপাস তৈরি হয় । আর তাই নাকের এলার্জি যেটাকে আমরা এলার্জিক রাইনাইটিস বলি এবং গলার এলার্জি যেটাকে আমরা এলার্জিক ফ্যারিনজাইটিস এবং ফুসফুসের এলার্জি যেটাকে আমরা অ্যাজমা বা হাঁপানি বলে থাকি।
আর এই একটা আরেকটার সঙ্গে জড়িত । যাদের নাকের এলার্জি আছে তাদের শতকরা ২০ থেকে ২৯ ভাগ রোগীর ক্ষেত্রে হাঁপানি আছে। তাই যাদের হাঁপানি আছে তাদের ৫৬থেকে ৭০ ভাগ রোগীর ক্ষেত্রে নাকের এলার্জিও থাকে।
তাই বিশেষভাবে বলা উচিত,যে নাকের এলার্জি ও ফুসফুসের এলার্জির (হাঁপানি) একটির প্রভাব আরেকটির ওপর পড়ে। তাই নাকের এলার্জি ঠিকমতো কন্ট্রোল না করলেও অনেক সময় হাঁপানি বেড়ে যায় এর পারে বা হাঁপানির চিকিৎসা করা কঠিন হতে পারে। তাই এই রকম ফুসফুসের এলার্জি বা হাঁপানি ঠিকমতো চিকিৎসা না করা হলে এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া নাকের ওপর পড়ে।
নাকের পলিপাস দূর করার সঠিক চিকিৎসাঃ
এটির প্রাথমিক চিকিৎসা হলো ধুলাবালি, ধোঁয়া এবং ঠাণ্ডা এড়িয়ে চলা। আবার প্রাথমিক পর্যায়ে এই রোগ ধরা পড়লে নাকে স্টেরয়েড জাতীয় স্প্রে ব্যবহার করলে এটি চলে যেতে পারে। পলিপাস যদি নাককে সম্পূর্ণ ভাবে বা আংশিকরূপে বন্ধ করে দেয়, তাহলে সাধারনত ওষুধের কাজ করতে চায় না। তাই এরকম ক্ষেত্রে অপারেশনের মাধ্যমে পলিপাস ফেলে দেয়া ছাড়া বিকল্প আর কোনো পথ থাকে না। আবার নাকের পলিপের কয়েক ধরনের অপারেশন হতে পারে।
আমরা নাককে অবশের মাধ্যমে নাকের পলিপাস বের করে নিতে পারি। এতে করে নাকের ভেতরের অংশটুকু কিছু হলো ও দূর করা সম্ভব। আবার অজ্ঞান করে তা আরও ভালোভাবে আমরা এই পলিপাসগুলো ফেলতে পারি। এতে করে সাইনাসের ভেতরে যে ঝিল্লির মতো থেকে তা পলিপাস গুলো তৈরি হয় এবং সেটা সম্পূর্ণভাবে দূর করা সম্ভব হয় না ।
তাই আধুনিক এ যুগে নাকের পলিপাসের সর্বশেষ এবং সর্বাধুনিক চিকিৎসা হলো এন্ডোস্কোপের মাধ্যমে পলিপাসগুলো এর শিকড় থেকে অর্থাৎ সাইনাসের যে ঝিল্লির থেকে পলিপাসের উৎপত্তি হয় সেইখান থেকেই সম্পূর্ণরূপে ফেলে দেয়া উচিত। আবার এন্ডোস্কোপ ব্যবহার করে ও আমরা এটি অতি সূক্ষ্মভাবে পলিপাসের উৎপত্তিস্থল থেকে পলিপাসকে ফেলে দিতে পারি।তাই যে কোনো সাইনাস নাক থেকে যত দূরেই হোক না কেন তার ভেতরে সূক্ষ্মভাবে তা প্রবেশ করে পলিপাস টাকে সম্পূর্ণভাবে বের করে ফেলা সম্ভব হয় ।
আরো পড়ুনঃ কিডনি ভাল রাখতে যেসব খাবার খাবেন। কিডনি ভাল রাখার সহজ উপায়।
আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থায় এন্ডোস্কোপের সাহায্য পলিপাস ফেলে দেয়া ছাড়া আর বিকল্প কোনো অপারেশন নাই । পলিপাস গুলো তাদের উৎপত্তিস্থল থেকে সম্পূর্ণভাবে ফেলে দিলে তা সাধারনত নতুন করে পলিপাস হয় না। পুরনো পদ্ধতিতে পলিপাসের অপারেশন করা হলে তা পলিপাসের কিছুটা অংশ সাইনাসের ভেতরে থেকে যায় এবং তা থেকে আবার পলিপাস নতুন করে অতি দ্রুত তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে যায়। যেহেতু পলিপাস সম্পূর্ণরূপে দূরীভূত হয় না, আবার যেহেতু পলিপাস উদ্ভূত সমস্যাগুলো বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই খুব একটা দূরীভূত হয় না ।
তাই বলে রাখা দরকার, সাধারনত পলিপাস ছাড়া নাকের ভেতর কিছু মারাত্মক ইনফেকশন, টিউমার, ক্যান্সার এবং অন্যান্য কিছু জটিল সমস্যা আপাতদৃষ্টিতে পলিপাস আকারে প্রকাশ পেতে পারে । তাই যদি মেডিকেল চিকিৎসাতে এই পলিপাসের বা পলিপাসের উপসর্গ সম্পূর্ণরূপে দূর একি বারে না হয় তবে এই পলিপাস থেকে বায়োপসি নিয়ে দেখা উচিত। সেটা আসলে পলিপাস নাকি অন্য কোনো সমস্যা তা বুঝতে হবে, যা অনেক ক্ষেত্রে মারাত্মক ও জটিলও হতে পারে। তাই অপারেশনের মাধ্যমে পলিপাস চিকিৎসা করাতে কিছুটা দেরি করা হয় । তবে এই বায়োপসি করা থেকে অবশ্যই আমাদের
লম্বা সময় বিরত থাকা উচিত নয়।
শেষ কথাঃ
নাকের পলিপাস একটি মারাত্মক সমস্যা। যাদের হয় তারা বুঝে এর কষ্ট। তাই সঠিক সময়ে দ্রুত চিকিৎসা করা উচিৎ অন্যথায় মারাত্মক সমস্যা হতে পারে। ধন্যবাদ
Leave a Reply