ঘাড় ব্যথার কারণ ও প্রতিকার: অনেক সময় দেখা যায় যে, ঘাড়ে হুটহাট টান লেগে আমাদের ব্যথা অনুভব হয়। এটা আসলে আমাদের সাথে হয়ে থাকা হরহামেশাই ঘটে বলে মনে করা হয়।আমাদের দৈনন্দিন চলাফেরা এবং নানা রকমের কাজে মধ্যে ভুল অঙ্গভঙ্গি কারনে বা আমাদের পেশির ওপর ভুল কারন বসত চাপ পড়ার কারণে আমরা অনেকেই আছে ঘাড়ব্যথার শিকার হয়ে থাকি।তাই শুধুমাত্র সঠিকভাবে দাঁড়ানো,এবং বসা বা আমাদের শোয়ার ভঙ্গি পরিবর্তন করেই বেশিরভাগ সময় ওই ধরনের ঘাড়ব্যথা থেকে আমাদের মুক্ত থাকা সম্ভব।
ঘাড় ব্যথার কারণ ও প্রতিকার
ঘাড় ব্যাথা মারাত্মক সমস্যা। যদি ঘাড়ব্যথা কারোর হয়েই যায় তাহলে ,আমাদের উচিত ঘাড়ের পেশিগুলোকে দুই একদিন বিশ্রাম দিলেই সাধারণত এই ঘাড় ব্যথা চলে যাবে। আবার অনেকের এই সমস্যা টা মারাত্মক আকার ধারণ করে। তাই আজকের এই আর্টিক্যালে ঘাড় ব্যাথার কারণ ও প্রতিকার সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করবো।
ঘাড় ব্যথার কারণ
প্রথমত বিভিন্ন কারনে এই ব্যথা হয়ে থাকে। আবার ঘাড়ে ব্যথা হওয়ার অন্যতম একটি কারণ হলো সঠিকভাবে উঠা নামা বা চেয়ারে না বসা। আবার সাধারণত বসার সময় আমরা অনেকেই মেরুদণ্ড সোজা করে বসি না। যার ফলে অনেক সময় আমাদের মাথা সামনে দিকে ঝুঁকে থাকে। তাই এর থেকেই হতে পারে দীর্ঘমেয়াদি ঘাড়ের ব্যথা।
কম্পিউটার অথবা মোবাইল ব্যবহার করার সময় বা দীর্ঘক্ষণ ঘাড় নিচু করে থাকলে তখন ঘাড় শক্ত হয়ে ব্যথা অনুভব হতে পারে।
কখনো কখনো টেলিভিশন দেখার সময় অনেকেই আছে যে সঠিকভাবে বসে থাকে না। তাই এতে ঘাড়ও অস্বাভাবিক অবস্থানে থাকে। তাই এর কারণেও আমাদের ঘাড়ে ব্যথার সৃষ্টি হতে পারে।
সাধারণত অনেকেই আছেন যারা অতিরিক্ত উঁচু বালিশ ছাড়া তাদের ঘুমি আসে না বা তারা ঘুমাতে পারেন না। তাই ঘুমের সময় বালিশের এমন ভুল ব্যবহার করার জন্য শুরু হতে পারে আমাদের ঘাড়ে ব্যথা।
অনেক সময় মহিলারা তাদের রান্নাবান্নার কাজের জন্য নিচু হয়ে বঁটিতে কাটাকাটি করে, এর কারনে ও কিন্তু হতে পারে ঘাড়ে স্থায়ী ঘাড়ের ব্যথা।
আবার সামনে ঝুঁকে ঝুঁকে অনেকক্ষণ ধরে কাজ করলে আমাদের ঘাড়ের মাংসপেশি শক্ত হয়ে যায়। ফলাফল আমাদের ঘাড়ে ব্যথা অনুভব হয়।
প্রচণ্ড গরমে বসে থাকলেও আমাদের ঘাড় ব্যথা বা ঘাড় নাড়াতে ও সমস্যা হতে পারে।
এছাড়াও ঘাড়ে আঘাত পেলে,
মাংসপেশি হঠাৎ টান৷ লেগে ছিঁড়ে গেলে বা
মচকে গেলেও ব্যথা হয়।
ঘাড়ের হাড়ের বা ডিক্সের সমস্যা, স্পনডাইলোসিস, স্পাইনাল ক্যানেল স্টেনোসিস, নিউরাইটিস, বোন টি – বি, সারভাইকাল রিব, এসব রোগ গুলো ও ঘাড় ব্যথার কারন হতে পারে।
আবার অতিরিক্ত মানসিক চাপ আর দুশ্চিন্তার কারণে অনেক সময় দেখা যায়, ঘাড়ের মাংসপেশিতে অনেক চাপ তৈরি হয় , যার কারণে ও কখনো কখনো ঘাড় ব্যথা শুরু হতে পারে।
ঘাড় ব্যথা কিসের লক্ষণ
অনেকেই মনে করেন ঘার ব্যথা হলে হযতো তা মারাত্মক কোন রোগের লক্ষণ। আসলে তা এমন কিছুই না। ঘাড় ব্যথা কোন রোগের লক্ষণ নয়। ঘাড় ব্যথা বিভিন্ন কারণে হয়ে থাকে। যা আমরা উপরে আলোচনা করেছি।
ঘাড় ব্যথার ব্যায়াম
ঘাড় ব্যথা প্রধানত দুই ধরনের হয়।
যথাঃ
১ / অ্যাকিউট’ বা স্বল্প সময়ের জন্য কিংবা ‘
২/ ক্রনিক’ বা দীর্ঘমেয়াদী।
তাই যে ধরনেরই হোক না কেনো ব্যথা তীব্র হলেই একজন অভিজ্ঞ চিকিৎসক পরামর্শ দেবেন যে কিছু ব্যায়ামের।
দীর্ঘমেয়াদী ঘাড় ব্যথার চিকিৎসায় ফিজিওথেরাপিই সবচাইতে বেশি সফল হয়েছে বলে ধারণা করা হয়।
তাই ব্যথা নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি আমাদের ঘাড়ের পেশির স্থিতিস্থাপকতা ও শক্তি বাড়ায় এই ফিজিওথেরাপির ব্যায়ামগুলোই।
নিচে কিছু ব্যায়ামের নিয়ম ব্যাখা করা হলো।
১/ ঘাড় ঘোরানোঃ
আস্তে আস্তে আমাদের ঘাড় যে কোনো একদিকেই ঘোরাতে হবে এবং সেভাবেই ধরে রাখতে হবে চার থেকে আট সেকেন্ড, এবং চেষ্টা করতে হবে যে ঘাড় ঘোরানোর সময় আমাদেত চোয়াল যেন একই উচ্চতায় থাকতে পারে। এখন যেদিকেই ঘাড় ঘুরিয়েছিলেন তার উল্টা দিকে আমাদেরকে ঘাড় ঘোরাতে হবে এবং আবারও সেই চার থেকে আট সেকেন্ড ধরে রাখতে হবে। এভাবে একটানা আমাদেরকে মোট ছয়বার এই ব্যায়ামটি করতে হবে।
২/ উপরে-নিচে ঘাড় বাঁকানোঃ
ঘাড় ব্যথা সারানোর জন্য সব চাইতে সহজ হলো এই ব্যায়ামটি। আমাদের শরীর সোজা রেখে শুধুমাত্র ঘাড় বাঁকা করেই আমাদের চোয়াল ছোঁয়াতে হবে বুকে। এভাবে সাত সেকেন্ড থাকতে হবে এবং আবার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরতে হবে। এভাবে এই ব্যায়ামটি পাচঁ বার করতে হবে।
৩/ ডানে-বামে ঘাড় বাঁকানোঃ
দুই কাধকে সোজা রেখে শুধুমাত্র ঘাড়কে বাঁকা করতে হবে এবং ডান কাঁধের দিকে, ছয় সেকেন্ড ধরে রাখতে হবে। এরপর কিছুক্ষণ আমাদের মাথা সোজা রেখে, বাম কাঁধের দিকে আবার ঘাড় বাঁকা করতে হবে এবং ছয় সেকেন্ড ধরে রাখতে হবে। এরপর আবারও মাথা সোজা করতে হবে। এভাবে করতে হবে সাতবার।
৪/কাঁধ টানটানঃ
পথমে আমাদের শরীর সোজা রাখতে হবে। এরপর ঘাড় সামনের দিকে বাড়িয়ে দিতে হবে এবং আমাদের দুই কাঁধ পেছনে টান দিয়ে রাখতে হবে। এই অবস্থান ছয় সেকেন্ড ধরে ধীরে ধীরে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসতে হবে। আর এই ব্যায়ামটি ও সাত বার করতে হবে।
তবে মনে রাখতে হবে যে, এই ব্যায়ামগুলো প্রতিদিন অনুশীলন করার পরও যদি কারোর এক বা দুই মাসে ব্যথা না সারে তবে একজন ভালো বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।আনুমানিক হিসেবে তিন থেকে চার সপ্তাহে ঘাড় ব্যথা সেরে যাওয়ার কথা।তাই ব্যথা সেরে গেলেই যেন আবার ফিরে না আসে সেরকম সচেতনতা অবলম্বন করতে হবে।
ঘাড় ব্যথার ঔষধ
ঘাড় ব্যথার প্রাথমিক পর্যায়ের চিকিৎসা ঘাড়ে কলার পরা, ব্যথার ঔষধ ভরা পেটে খাওয়া। ঔষধের মধ্যে
- Tab Naprosyn 500mg (1+0+1) 16 days,
- Cap Seclo 20mg (1+0+1) 30 days,
- Tab, onil (1+0+1) 30 days,
খেতে হবে। একই সাথে ফিজিওথেরাপিও করতে হবে। কোনো কারণে ভালো না হলে অঈউঋ নামক ঘাড়ের অপারেশন করাতে হতে পারে।
ঘাড় ব্যথা থেকে মুক্তির উপায়
- নরম বিছানা ছেড়ে সবসময় শক্ত সমান বিছানায় ঘুমানোর অভ্যাস করতে হবে।
- ঘুমানোর সময় শুধু মাথায় বালিশ না দিয়ে ঘাড়ের নিচে বালিশ দিতে পারেন।
- প্রয়োজনে বালিশ মাথা থেকে নিচে টেনে নামিয়ে ঘাড়ের নিচে রাখতে পারেন।
- কাজের জায়গায় চেয়ার টেবিল এমন ভাবে রাখা উচিৎ যেন মাথা ঘার সোজা থাকে। কখনো ঘাড় সামনে ঝুকিয়ে কাজ করতে না হয়।
- কখনো ব্যথা বেশি অনুভব হলে ঘাড়ে হালকা গরম সেক দিতে পারেন।
- ঘারে ব্যাথা অনুভব হলে আস্তে আস্তে ব্যায়াম করতে পারেন। এসময় ঘাড়ের ব্যয়াম বেশ আরামদায়ক ও উপকারি।
- এক সপ্তাহের মধ্যে ব্যাথা না কমলে তাহলে দ্রুত বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
ঘাড় ব্যথা প্রতিরোধে আমাদের করণীয়
১/ সামনের দিকে ঝুঁকে বেশিক্ষন কাজ না করা ।
২/ কাজের মাঝে মাঝে কিছু সময়ের জন্য বিশ্রাম নেওয়া।
৩/ সবার যারা কম্পিউটারে কাজ করেন তাদের কম্পিউটারের মনিটর চোখের লেভেল অনুযায়ী রাখা।
৪/ শোয়ার সময় খেয়াল রাখা যে, এক সাইজের বালিশ ব্যবহার করা , যার অর্ধেকটুকু মাথা ও বাকি অর্ধেকটুকু ঘাড়ের দিকে থাকে এমন বালিশ রাখা।
৫/ ঘাড়ের মাংসপেশির স্বাভাবিক ভাবে ঠিক রাখার জন্য ফিজিওথেরাপি বিশেষজ্ঞের পরামর্শ অনুযায়ী ব্যায়াম করা।
৬/ কোন ধরনের দুশ্চিন্তামুক্ত থাকা এবং প্রতিদিন ৫-৮ ঘণ্টা ঘুমানোর চেষ্টা করা।
ঘাড় ব্যথার ঘরোয়া উপায়
সাধারণত প্রথম কয়েকদিন বরফ লাগানো তারপরে একটি হিটিং প্যাড বা গরম তোয়ালে দিয়ে ছেঁক নেওয়া। গরম পানিতে গোসল করা, এবং ঘাড়ে গরম তাপ প্রয়োগ ও করতে পারেন।
আবার ডাক্তারের পরামর্শমতো আইবুপ্রোফেন বা প্যারাসিটামলের মতো ব্যথা উপশমকারী ওষুধ সেবনও করতে পারেন।
মনে রাখতে হবে আপনার ঘাড়ের ব্যথা বাড়িয়ে দেয় এমন ধরনের কাজ যেমন, ব্যায়াম, খেলাধুলা,ভারোত্তলন–এসব থেকে কিছু দিন দূরে থাকুন। এই কাজগুলোতে পুনরায় ফেরার সময় আস্তে আস্তে শুরু করতে পারেন।
নিয়মিত ঘাড়ের ব্যায়াম করুন। আস্তে আস্তে আপনার মাথা ডানে ও বায়ে ঘোরান এবং ওপরে-নিচে ঘোরান।
ওঠা, বসা, শোয়া, চলাফেরা এবং প্রাত্যাহিক জীবনের যেসকল কার্যকলাপে আপনার শরীরকে সঠিক ভঙ্গিতে রাখা উচিত সেসব অভ্যাস করুন।
কুঁজো হয়ে হাঁটা এবং অনেকক্ষণ ফোন বা কম্পিউটারের দিকে ঘাড় নিচু করে তাকিয়ে থাকা কিংবা আঁকাবাঁকা হয়ে শোয়ার অভ্যাস পরিত্যাগ করতে হবে। এতে করেই ঘাড় ব্যাথা থেকে অতিদ্রুত মুক্তি পাওয়া যাবে।
আপনার ঘাড় এবং আপনার কাঁধের মাঝা মাঝিতে মোবাইল ফোন রেখে কাজ করতে হবে।
একিভাবে এক অঙ্গি বঙ্গিতে দাড়ানো বা বসা যাবে না। তাই প্রতিনিয়ত আপনার অবস্থান পরিবর্তন করতে হবে।
আপনি চাইলে আপনার ঘাড়ের হালকা মাসাজ করে নিতে পারেন।এতে করে আপনি আরাম পবেন।
আপনার ঘুমের জন্য আরাম দায়ক বালিশ নির্ধারণ করুন এবং তা ব্যবহার করুন যাতে করে আপনার ঘাড়কে সঠিক অবস্থানে রাখতে পারেন
শেষ কথা
ঘাড়ের ব্যাথা খুব অল্প দিনের মধ্যে সেরে যেতে পারে। তাই ঘাড়ের ব্যাথা নিয়ে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। তবে আমাদের উচিত কিছু কিছু সময় , ঘাড়ের এই ব্যাথা অনেক গুরুতর আঘাত বা শরীররের অসুস্থতার কারন হয়ে দাড়াতে পারে। তাই যদি কারোর ঘাড়ের ব্যাথা দুই সপ্তাহের বেশি সময় ধরে থাকে , তাহলে অবশ্যই এটিকে সামান্য ব্যাথা বলে অবহেলা করা যাবে না। তাই যথা সম্ভব আপনাকে , বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে।
Leave a Reply